শিশু নির্যাতনের ঘটনা যে কোনো সময়ের চেয়ে এখন অনেক বেশি আমাদের দেশে। একটি ঘটনা ভুলতে না ভুলতেই নজিরবিহীন ভাবে আরেকটি ধর্ষণ ও হত্যাকাণ্ড ঘটছে। ৩ মাস থেকে ১৩/১৪/১৫ বছর বয়সী ছেলে ও মেয়ে উভয় শিশুরা ধর্ষণ ও হত্যার স্বীকার হচ্ছে। ভিকটিমের বাবা-মায়েরা ঘটনা বাস্তব না দুঃস্বপ্ন বুঝে উঠতে না উঠতেই আবার দীর্ঘ বিচার প্রক্রিয়া আর জটিলতার মধ্যে পড়েন। এখন অপেক্ষার প্রহর গুনছি আমরা। কবে এই অবস্থার পরিবর্তন হবে? সরকার, রাষ্ট্র, প্রশাসন এ অবস্থার পরিবর্তন ঘটাতে হয়তো অনেক পদক্ষেপ নেবে। কিন্তু এরকম পরিবর্তনের জন্য মূলত প্রথম ভূমিকা অভিভাবককেই নিতে হবে। অভিভাবকরা যদি সচেতন না হয়, আইন প্রণয়ন বা দ্রুত বিচার করেও দীর্ঘমেয়াদী সুফল পাওয়া যাবে না। কিভাবে সচেতন হলে সন্তানের জীবন ও সম্ভ্রমের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা যাবে? সেটাই আজ আমরা খুঁজবো।
সচেতনতার শুরু:
১। শিশু ছেলে হোক বা মেয়ে প্রথমে এগিয়ে আসতে হবে মা কিংবা মায়ের অনুপস্থিতিতে বাবাকেই। ‘ইয়েলো ব্রিক রোড’ কাজ করছে এই বিষয় নিয়ে। প্রতিষ্ঠানটির ব্যবস্থাপনার পরিচালক ফারিন দৌলা বলেন, মা, বাবা তথা পরিবারকেই শিশুর সুরক্ষা নিশ্চিত করতে হবে। তাঁকে ভালো স্পর্শ, মন্দ স্পর্শের শিক্ষা দেওয়ার পাশাপাশি সে কোথায় যাবে কিংবা কার সাথে খেলা করবে এসব দিকেও খেয়াল রাখা উচিত। খোলাখুলি ভাবে অন্যান্য যে কোন বিষয়ের মতো করেই এগুলো শিক্ষা দিতে হবে। তা যেন কোন ভাবে শিশু মনে আতঙ্ক বা ভয় সৃষ্টি না করে সে খেয়াল ও রাখতে হবে বলে মনে করেন ফারিন।
শিশু কথা বোঝার পর থেকেই তার সাথে শিশুসুলভ কথা, আদুরে ভাষায় কথা বলার হার অর্ধেকে নামিয়ে আনতে হবে। শিশুরা অনুকরণপ্রিয়, বাবা-মা যেভাবে কথা বলবে, সেটাই তারা বুঝবে এবং অনুকরণ ও অনুসরণ করবে। তাই আগে তার সাথে যোগাযোগের ভাষার উপর কাজ করতে হবে, মানে পারষ্পারিক সাধারণ কথা ও ভাব বিনিময়ে অভ্যস্ত করাতে হবে। ৯ মাস থেকে ৩ বছর বয়সী শিশুদের স্বাভাবিক কথাবার্তা ও ভাববিনিময়ে অভ্যস্ত করালে অভিভাবকের যে কোনো কথা তারা শোনার ও বোঝার অভ্যাস করতে পারবে।
২। শিশু মনস্তত্ব নিয়ে বাংলাদেশী বাবা-মায়েরা রীতিমত পুরোটাই অন্ধকারে থাকে। বেশিরভাগই শিশুদের মস্তিষ্ক ও মনস্তত্ত্বের স্বাভাবিক গতি বোঝেনা। তারা মনে করে একটি শিশু কিছুই বোঝেনা। আসলে তা নয়, একটি দুই বছরের শিশুও অনেক কিছু বুঝতে পারে, বাবা মায়ের গম্ভীর চেহারা ও হাসিমাখা চেহারার মানে কি, কোন আচরণটি আদরের, কোনটি বিরক্তি ও রাগের, এমন কি ধমক বা গায়ে হাত দেয়া ছাড়াই বুঝতে পারে। ফলে শরীরের কোন কোন অংশ স্পর্শকাতর ও একান্ত ব্যক্তিগত, কোন অংশ স্পর্শকাতর নয় ইত্যাদিও সে নিজে থেকেই বুঝতে পারে। তবুও তাকে সেটা বলতে ও বোঝাতে হবে- অন্তত কোন অংশের কি নাম শিশুকে জানাতে হবে কোন রকম মিথ্যার আশ্রয় না নিয়ে।
৩। এরপর তাদেরকে শরীরের প্রাইভেট বা ব্যক্তিগত অংশগুলোর গুরুত্ব বোঝাতে হবে। শিশুকে বোঝাতে হবে ঐ প্রাইভেট বা ব্যক্তিগত অঙ্গগুলো সে ছাড়া অন্য কেউ স্পর্শ করা উচিৎ নয়। এমন কি বাবা-মা ও নয়। এতে বয়স বাড়ার সাথে সাথে বা ৫ বছর বয়সের আগেই সে তার ব্যক্তিগত অঙ্গগুলোর নিরাপত্তায় অবচেতন ভাবে সচেতন হতে পারবে।
৪। ইন্টারনেটে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম বিশেষত ফেসবুক ও ইউটিউবে প্রচুর বাংলা ভিডিও কনটেন্ট রয়েছে এখন ভাল স্পর্শ ও খারাপ স্পর্শ বোঝানোর জন্য। নির্ধারিত কিছু ভিডিও বাচ্চাদের দেখানো যেতে পারে। সেই সাথে যারা জানেন না সেই সকল অভিভাবকদেরও দেখতে হবে জানার জন্য। সাধারণত ‘ভাল স্পর্শ খারাপ স্পর্শ’ লিখে সার্চ দিলেই অনেক ভাল ভাল বাংলা ভিডিও কনটেন্ট পাওয়া যাবে ইউটিউবে। প্রি স্কুলগুলোতে বা প্রাথমিক বিদ্যালয়ে এ ধরণের ডিজিটাল কনটেন্ট দেখানোর উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে শিশু ও অভিভাবকদের জন্য।
শুধু ভিডিও কনটেন্টই না, অনেক সময় ছবি দেখিয়ে বা ছবি একেও ভাল স্পর্শ কি, খারাপ স্পর্শ কি বোঝানো যায় শিশুকে।
৫। কেউ শিশুদের ব্যক্তিগত স্থান স্পর্শ করলে তাকে সাথে সাথে ‘না’ বলার জন্য শিশুকে অভ্যাস করাতে হবে। সে যেন বিষয়টি বাবা-মায়ের সাথে শেয়ার করে সাথে সাথে সেটাও তাকে বলতে হবে। সেই সাথে সেই ব্যাক্তি থেকে দূরে থাকা, কোন কিছু দিয়ে লোভ দেখাতে চাইলে প্রত্যাখ্যান করা, চিৎকার করা এবং দৌড়ে সরে যাওয়াও শেখাতে হবে।
৬। অপরিচিত কোন ব্যাক্তি কিছু খেতে দিলে খাওয়া যাবে না , কোথাও নিয়ে যেতে চাইলে যাওয়া যাবেনা, বাবা মাকে না বলে কোথাও একা বা কারো সাথে যাওয়া যাবেনা এটা শিশুদের বলতে হবে।
৭। শিশুদের বলতে হবে যে যারা ব্যক্তিগত অংশগুলোকে খারাপভাবে ধরে বা স্পর্শ করে তারা খুব খারাপ লোক। তারা সাধারণত এই বিষয়গুলো গোপন রাখতে চায় বা শিশুকে গোপন রাখার জন্য ভয় দেখায়। তবে ভয় দেখালেও সবকিছু বাবা-মা বা শিক্ষক কে বলতে হবে।
৮। একই সাথে ভাল স্পর্শ কিসে? সেগুলোও শিশুকে বলতে বা বোঝাতে হবে। বাবা মায়ের আদর, ভাইবোনের আদর, শিক্ষকরা প্রশংসা করে পিঠে বা মাথায় হাত বোলাতে পারে, ডাক্তাররা অনেক সময় শরীর পরীক্ষা করার জন্য স্পর্শ করতে পারে, এছাড়া পড়ে গেলে বা দুর্ঘটনা ঘটলে সাহায্য করার জন্য কেউ স্পর্শ করতে পারে বা ধরতে পারে।
৯। অপরিচিত বা পরিচিত কেউ নিরিবিলি জায়গায় নিয়ে যেতে চাইলে বা কোন কথা বললে, শিশুরা সেটা যাতে না শোনে, বরং দ্রুত সেখান থেকে সরে যাওয়ার জন্য বলতে হবে।
১০। শিশুরা এ ধরণের বিপদজনক আচরণের সম্মুখীন হলে তারা যে কোনভাবে দোষী নয় সেটা আগে তাদেরকে বোঝাতে হবে।
১১। শিশু কে শারীরিক বিষয়গুলো বা ভাল বা মন্দ স্পর্শের সংক্ষেপে ও সহজ ভাষায় বোঝানোর চেষ্টা করতে হবে। খুব বেশি ব্যাখ্যা করলে সে না ও বুঝতে পারে।
১২। তার কাছ থেকে প্রশ্ন আশা করতে হবে। তার প্রশ্ন বা কথায় হাসা যাবে না। এতে সে আত্মবিশ্বাস হারিয়ে ফেলতে পারে।
১৩। জোর করে বা অতিরিক্ত আদর করা থেকে বিরত থাকতে হবে শিশুরা নির্যাতিত হলেও অনেক সময় অভিভাবকরা বুঝতে পারে না। কারণ তারা অনেক সময় বলে না। কোন শিশু নির্যাতিত হলে তার আরও বেশি মানসিক যত্ন নিতে হবে। তাকে আস্বস্ত করতে হবে যে এতে তার কোন দোষ নেই, তারা অনেক নিরাপদ পরিবারে। তাকে সচেতন করতে হবে। নির্যাতিত বা নির্যাতিত হতে পারে এরকম শিশুর আচরণে কিছু লক্ষণ প্রকাশিত হয়। যেমনঃ
- নিজের স্পর্শকাতর অঙ্গ প্রত্যঙ্গ অপ্রয়োজনে নাড়াচাড়া করা।
- ছোট ভাইবোন থাকলে তাদের স্পর্শকাতর অঙ্গপ্রত্যঙ্গ কৌতুহলবশত ধরা।
- মুডসুইং এবং অল্পতেই চিৎকার করা ও রেগে যাওয়া, হঠাত ব্যক্তিত্বের পরিবর্তন।
- কোন কিছু লুকানোর প্রবণতা।
- হুট করে বয়স্ক বন্ধুর কথা বলা, উপহার পাওয়া।
- রাতে দুঃস্বপ্ন দেখে জেগে ওঠা।
- আত্মহত্যার প্রবণতা।
বাংলাদেশ শিশু অধিকার ফোরামের জরিপ অনুযায়ী এ বছরের প্রথমার্ধে মোট ৪৯৬ ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে যার মধ্যে ৫৩জন গণধর্ষণের শিকার হয়েছে ও ২৩ জনকে ধর্ষণের পরে হত্যা করা হয়েছে। গত বছরের চেয়ে শিশু ধর্ষণের হার বেড়েছে এ বছর ৪১%। ভয়ানক আশংকার বিষয় হল, এসব ঘটনার এক তৃতীয়াংশেরও মামলা হয়নি।
প্রতি মাসে অন্তত ৮০ জন শিশু সারাদেশে গড়ে নির্যাতনের শিকার হচ্ছে। ক্রমবর্ধমান এই হার ঠেকাতে সচেতনতার কোন বিকল্প নেই। ধর্ষণ না কমাতে পারলে সমাজে শুরু হয় মানবিক ও মূল্যবোধ বিপর্যয়। গত কয়েক মাসে পিতা কর্তৃক কন্যাসন্তান বা মাদ্রাসা বা স্কুলে শিক্ষক কর্তৃক শিশু শিক্ষার্থী ধর্ষণের মত ঘটনাও ঘটেছে। তাই এখনই সময় এ বিষয়ে সচেতন হবার। নয়তো সায়মা, নাইম, পূজার মত সহস্র নাম ঝরে যাবে, প্রতিমাসের ৮০ জনের তালিকায় হয়তো আপনার বা আমার সন্তানের নামও একদিন যুক্ত হয়ে যাবে।