বাংলাদেশে স্টার্টআপ কালচার শুরু হয়েছে বেশ কয়েক বছর আগেই। ব্যবসার ক্ষেত্রে নতুন আইডিয়া, প্রচুর পরিশ্রম ও মেধা খাটিয়ে যথাসম্ভব কম খরচ করে সফল হচ্ছেন অনেকেই। ব্যবসায় ফান্ডিংয়ের প্রয়োজন আছে ঠিকই কিন্তু সফলতার অনেকখানি নির্ভর করে সততা ও পরিশ্রমের ওপর। একজন মেয়ের জন্য ব্যবসার ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধকতা শুরু হয় পরিবার থেকেই। পাশাপাশি সমাজ, আশেপাশের মানুষের দৃষ্টিভঙ্গি ইত্যাদিও একজন নারীর জন্য চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়ায়। ব্যবসা করার সময় বলতে গেলে প্রতিটা সময়, প্রতিটা মুহূর্তেই চ্যালেঞ্জের মোকাবেলা করতে হয় একজন নারীকে কিন্তু বর্তমান সময়ে তৃণমূল পর্যায় থেকে শুরু করে অনেক শিক্ষিত নারীও চাকরির পাশাপাশি বা চাকরির পরিবর্তে ব্যবসায়ের দিকে ঝুকছেন এবং এর মাধ্যমে অনেকের কর্মসংস্থানের সুযোগও তৈরি করে দিচ্ছেন।
স্বল্প মূলধনে ব্যবসা শুরু করার সম্ভাবনাময় খাত হস্তশিল্প
স্বল্প মূলধনের ব্যবসা গুলোর মধ্যে হস্তশিল্পের ব্যবসা বর্তমানে খুবই জনপ্রিয়। বাংলাদেশে মৃৎ শিল্প, ব্লক-বাটিক, প্রিন্টিং, তাঁত বা বুনন শিল্প, বাঁশ ও বেত শিল্প, নকশী কাঁথা তৈরী ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য হস্তশিল্প বেশ প্রচলিত। দেশ বিদেশের বাজারে হস্তশিল্প পণ্যের যথেষ্ট চাহিদা রয়েছে। তথ্য প্রযুক্তির উন্নয়ন নারীর পথচলাকে আরও সহজ করে তুলেছে। ইতিমধ্যে পরিবার সামলে, ঘরে বসেই হস্তশিল্প নিয়ে অনলাইনে ব্যবসা করছেন অনেক নারী। বর্তমানে বেসিসের তালিকাভুক্ত প্রায় তিন হাজার ফেসবুক পেইজ আছে যার মধ্যে ধারণা করা যায় প্রায় ৭০০ পেইজ নারী উদ্যোক্তাদের।
নতুন ব্যবসা কিংবা কোন উদ্যোগ গ্রহণের ক্ষেত্রে পুঁজি বা ফান্ডিং জোগাড় করা খুবই জরুরী। প্রয়োজনীয় পুঁজির অভাব এবং সংশ্লিষ্ট খাতে পুঁজি বা ফান্ডিং জোগাড় করার উপায়গুলো সম্পর্কে ধারণার অভাবে অনেকেই বিশেষ করে নারীরা পিছিয়ে পড়েন । এক্ষেত্রে হস্তশিল্প ব্যবসার সুবিধা হলো অল্প পুঁজিতে এটি শুরু করা যায়। তবে তৃণমূল পর্যায়ের নারী যারা কিনা দারিদ্রতার মধ্যে দিয়ে যাচ্ছেন তাদের ক্ষেত্রে বিভিন্ন আন্তর্জাতিক স্বীকৃতিপ্রাপ্ত এনজিও, ব্যাংক ইত্যাদি ক্ষুদ্র ও কুটিরশিল্পের জন্য ক্ষুদ্র ঋণ প্রকল্পের আওতায় ঋণ প্রদান করে থাকে। এছাড়াও স্টার্টআপের অর্থায়নের জন্য বিভিন্ন মন্ত্রণালয় প্রায়ই বিভিন্ন ধরনের সরকারি প্রকল্প হাতে নিয়ে থাকে।
বাংলাদেশের প্রায় প্রতি জেলার নারীরাই বিভিন্ন হস্তশিল্পে পারদর্শী।
কিন্তু পারদর্শিতার পাশাপাশি একটা ব্যবসা দাঁড়ান করানো ও পণ্য বিক্রেতার কাছে পৌঁছে দেয়ার পন্থা সম্পর্কেও ধারণা থাকা প্রয়োজন সেক্ষেত্রে বর্তমানে উদ্যোক্তা তৈরি ও প্রশিক্ষণের জন্য দেশে এখন অনেক প্লাটফর্ম রয়েছে। একটা সময় হস্তশিল্পীদের সারা বছরের আয় নির্ভর করতো বিভিন্ন জাতীয় ও আন্তর্জাতিক মেলা ও পাইকারি সংস্থাগুলির ওপর কিন্তু বর্তমান ইন্টারনেটের যুগে অনলাইনে খুব সহজেই খুচরো দামে হস্তশিল্প সামগ্রীগুলো ক্রেতার নিকট বিক্রি করা যায় এছাড়া এলাকার বাজার গুলিতে এখন নারীরাও পুরুষদের পাশাপাশি ব্যাবসা করছেন। হস্তশিল্পের কাজ করে কর্মসংস্থানের জন্য যে কেবল উদ্যোক্তাই হতে হবে এমনটা নয়, দক্ষতা থাকলে কর্মী হিসেবেও কাজ করা সম্ভব। হস্তশিল্পজাত পণ্য রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠান সান ট্রেড লিমিটেড এর ফ্যাক্টরিগুলোতে নব্বইভাগই নারী কর্মী।এ প্রতিষ্ঠান টি মূলত পাট, খেজুরপাতা, তালপাতা, সিগ্রাস, হোগলা পাতা, বেত দিয়ে তৈরি গৃহস্থালী পণ্য রপ্তানি করে থাকে।
বর্তমান সময়ে এমন অনেক সফল নারী উদ্যোক্তার সন্ধান মিলবে যারা হস্তশিল্প ব্যবসায় সফলতার সাথে কাজ করে যাচ্ছেন। তুলিকা নামক পাটপন্যভিত্তিক কোম্পানির প্রতিষ্ঠাতা ইশরাত জাহান চৌধুরী তার ব্যাংকের চাকরি ছেড়ে নিজ ব্যবসায় তিন বছরেই পেয়েছেন সাফল্য। বিদেশের বাজারে স্থান করে নিয়েছে তার প্রতিষ্ঠানের পন্য। ব্যবসার ক্ষেত্রে তার মূলধন ছিল নিজের সঞ্চিত অর্থ এবং নিজে সাবলম্বী হওয়ার পাশাপাশি অন্যদেরকে কাজের সুযোগ করে দেয়ার স্বপ্ন।
বিবিএ, এমবিএ শেষ করে তথাকথিত চাকরির পিছে না ছুটে এফ-কমার্সের মাধ্যমে অনলাইনে ছোট পরিসরে ফ্যাশন প্যাশন নামে নিজের ব্যবসা শুরু করেছিলেন রুবাইয়াত ইমি। স্থানীয় বাজার থেকে দেশীয় পণ্য কিনে সেগুলোকে আরও আকর্ষণীয় ভাবে উপস্থাপনের লক্ষে কাজ করছেন তিনি । মূলত কারচুপি ড্রেস, শাড়ি পাঞ্জাবী, জারদোশি, মসলিনের উপর জারদোশি কাজ করে থাকে তার প্রতিষ্ঠান । প্রি-অর্ডার নিয়ে কাজ করেন বলে খুব বেশি ইনভেস্টমেন্টেরও প্রয়োজন পড়ে না।
নওরিন আক্তার পেশায় একজন সাংবাদিক যিনি তার কাজের পাশাপাশি ‘সারানা’ নামক এফ-কমার্স পেজে নিজের ব্যবসা চালিয়ে যাচ্ছেন যেখানে তিনি হাতে আঁকা টিপ, হাতে তৈরি গয়না, টাঙ্গাইলের শাড়ি ইত্যাদি দেশীয় জিনিস বিক্রয় করেন। কোন রকম প্রাতিষ্ঠানিক প্রশিক্ষণ ছাড়াই সম্পূর্ণ নিজের প্রচেস্টায় তিনি দাঁড় করিয়েছেন তার এ ব্যাবসা। সাতক্ষীরা শহরের থানাঘাটা এলাকার ফাতেমা বেগম হস্তশিল্পের মাধ্যমে দূর করেছেন নিজ পরিবারের অভাব, পাশাপাশি স্বাবলম্বী করে গড়ে তুলেছেন ৮০ জন পরুষ ও ৪০ জন নারীকে। ঢাকা থেকে কাপড় ক্রয় করে নিজ ফ্যাক্টরিতে হ্যান্ডিক্রাফট করার পর থ্রি পিস, গাউন, সারারা, পাঞ্জাবী, শাড়ি তৈরি করে সেগুলো ঢাকার বসুন্ধরা, গাউসিয়া, ধানমন্ডি এলাকার ব্যবসায়ীদের কাছে বিক্রয় করেন তিনি। মাত্র চার হাজার টাকা মূলধনে ব্যবসা শুরু করে বর্তমানে শ্রমিকদের বেতন দেয়ার পরও প্রতিমাসে প্রায় ৪৫-৫০ হাজার টাকা ব্যবসায় লাভ হয় তার।
উপরোক্ত নারী ব্যবসায়ীদের মত হাজারও নারীরা বর্তমানে নিজের সৃজনশীলতা, ব্যবসায়িক বুদ্ধি, রুচিবোধ, গ্রাহকের মানসিকতা ইত্যাদিকে কাজে লাগিয়ে হস্তশিল্প নিয়ে ক্ষুদ্র ও বৃহৎ উভয় পরিসরে কাজ করে যাচ্ছেন। একজন গৃহিণী বা কর্মজীবী নারী তাদের কাজের পাশাপাশি, এমন কি নিজের পেশা হিসেবেও হস্তশিল্পের মাধ্যমে নিজের আর্থসামাজিক মর্যাদা বৃদ্ধিতে ভূমিকা রাখতে পারেন।