উন্নত দেশগুলোর তুলনায় বাংলাদেশে ই-কমার্স এর অবস্থান একেবারে প্রাথমিক পর্যায়ে হলেও এই করোনাকালে লকডাউন, বিভিন্ন স্থানে জমায়েতে নিষেধাজ্ঞা ইত্যাদি কারণে মানুষ এখন ঘরে বসেই নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিস যেমন ওষুধ, পোশাক, গহনা, ইলেকট্রনিক্স সামগ্রী, কসমেটিক্স, খাদ্যদ্রব্যসহ সব ধরনের পণ্য অনলাইনে অর্ডার করছেন। যার ফলে স্বাভাবিক সময়ের তুলনায় অনলাইন মাধ্যম ব্যবহার করে ক্রয়-বিক্রয়ের হার বেড়েছে প্রায় ৬০ থেকে ৭০ শতাংশ। জার্মান ভিত্তিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান স্ট্যাটিস্টা এর তথ্য মতে বর্তমানে বাংলাদেশে ই-কমার্সের বাজার দেড় বিলিয়ন মার্কিন ডলার ছাড়িয়েছে যা ২০২৩ সালের ভেতর তিন বিলিয়ন ডলার ছাড়াবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। বিভিন্ন বিদেশী ই-কমার্স সাইট যেমন দারাজ, আমাজন, কিউভি এর পাশাপাশি রকমারি, আজকের ডিল, বাগডুম, প্রিয় শপ, পিকাবু, চাল-ডাল ইত্যাদি বাংলাদেশী ই-কমার্স সাইটও বর্তমানে বাংলাদেশে সক্রিয়ভাবে কাজ করে যাচ্ছে।
ইন্টারনেট ব্যবহার করে এক ব্যবসা প্রতিষ্ঠান থেকে অন্য ব্যবসা প্রতিষ্ঠান বা ভোক্তার সাথে প্রায় স্বয়ংক্রিয়ভাবে পণ্য ক্রয়-বিক্রয় প্রক্রিয়াই হচ্ছে ই-কমার্স। বাংলাদেশের প্রতিটি প্রান্তে তথ্য ও যোগযোগ প্রযুক্তির ব্যাপক সম্প্রসারণ ও ইন্টারনেট সেবার সহজলভ্যতার কারণে ই-কমার্সের সুযোগ বাড়ছে। পুরুষ উদ্যোক্তা ছাড়াও বিভিন্ন উদ্যোক্তা প্রতিষ্ঠানের সাথে জড়িত আছেন প্রায় চার লাখ নারী উদ্যোক্তাও।
দারিদ্র্যতা বিমোচনে শুধু গ্রামীণ পর্যায়ের নারীরাই নয় বরং অনেক শিক্ষিত নারী যারা সংসারের চাপসহ নানা সমস্যার কারণে চাকরির সুযোগ পাচ্ছেন না, এমন কি বর্তমানে অসংখ্য তরুণী চাকরির পরিবর্তে নিজেকে উদ্যোক্তা হিসেবে গড়ে তুলতে ই-কমার্স কে মাধ্যম হিসেবে ব্যবহার করছেন।
অনলাইন ভিত্তিক হওয়ায় নারীদের ঘরে বসে কাজ করার সুযোগ তৈরি করে দিয়েছে ই-কমার্স। এছাড়া ই-শপ সেন্টারে ক্রেতা ও বিক্রেতার মাঝে কোনো মধ্যস্বত্বভোগী না থাকায় এটি তুলনামূলক ভাবে লাভজনক। বর্তমানে ক্ষুদ্র ও মাঝারি ব্যবসার জন্য সরকারি ব্যাংক থেকে বিনা জামানতে ও সহজ শর্তে ঋণ প্রদান করা হয়ে থাকে যা নারীদেরকে নিজের কর্মসংস্থানে আরও আগ্রহী করে তুলেছে। শহর থেকে গ্রাম সকল স্তরের নারীর ক্ষমতায়নে সরকারি বিভিন্ন ছোট বড় প্রকল্প দেশের লাখ লাখ নারীকে উদ্যোক্তা হিসেবে গড়ে তুলতে সহায়ক ভূমিকা পালন করে চলছে। তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি বিভাগ দ্বারা পরিচালিত ‘শি পাওয়ার’ বা প্রযুক্তির মাধ্যমে নারীর ক্ষমতায়ন প্রকল্প এর মধ্যে অন্যতম।
সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমকে কাজে লাগিয়ে ২০১৭ সালে গড়ে ওঠা নারী উদ্যোক্তাদের অনলাইন প্লাটফর্ম ‘উইমেন অ্যান্ড ই-কমার্স ফোরাম (উই) মূলত বাংলাদেশের ৬৪ জেলার উদ্যোক্তাদের সমন্বয়ে গঠিত একটি প্ল্যাটফর্ম, যেখানে সবাই নিজ জেলার পণ্য অনলাইনের মাধ্যমে উপস্থাপণ ও বেচা-কেনা করেন। এছাড়াও বিভিন্ন বিষয়ে কর্মশালা ও প্রশিক্ষণের মাধ্যমে অনলাইন এ প্ল্যাটফর্মটি বিপুল সংখ্যক নারী ই-কর্মাস উদ্যোক্তা তৈরির পাশাপাশি নারীর কর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরি করে দিচ্ছেন। উইয়ের দ্রুত জনপ্রিয় হয়ে ওঠার পেছনে অন্যতম কারণ এখানে পণ্য বিক্রির আগে কিংবা পরে কাউকে কোনো চার্জ বা কমিশন দেয়ার প্রয়োজন হয় না।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় হতে রাষ্ট্রবিজ্ঞানে পড়াশুনা শেষ করে রুমানা ক্ষুদ্র পরিসরে শুরু করেন অনলাইনে নিজের ডিজাইন করা থ্রিপিস, শাড়ি, শার্ট, বেডশিট, কুশন ইত্যাদি পণ্য বিপণনের কাজ। কাজের প্রতি শ্রদ্ধা ও অক্লান্ত পরিশ্রম তাকে কয়েক বছরের মধ্যেই সফল উদ্যোক্তা হিসেবে নিজেকে গড়ে তুলতে সাহায্য করেছে। কলেজের প্রশাসনিক বিভাগে কর্মরত পারাহিতা চাকমা চাকরির পাশাপাশি মেয়ে ও মা মিলে গড়ে তুলেছেন অনলাইন ভিত্তিক ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর খাবারের ব্যবসা। আশানুরূপ সাড়াও পাচ্ছেন। ডিজিটাল মার্কেটিং বিষয়ে প্রশিক্ষণ নিয়ে খুব স্বল্প সঞ্চয়ে ফেসবুক পেজের মাধ্যমে পোশাক ও গয়না বিক্রির কাজ শুরু করেন উদ্যোক্তা নুসরাত আক্তার। অনেক চড়াই উৎরাই পেরিয়ে বর্তমানে সফলতার সাথে দেশে–বিদেশে তাঁতের পোশাক বিক্রি করছেন তিনি। এভাবে বর্তমানে বহু নারী ই-কমার্স পরিচালনার মাধ্যমে নিজের কর্মসংস্থানের পথ বেছে নিচ্ছেন।
ই-কমার্স ব্যবসা শুরুর পূর্বে অবশ্যই অন্যান্য ওয়েবসাইট ও ব্যবসা গুলোকে পর্যাবেক্ষণ করতে হবে, তারা কিভাবে কাজ করছেন, কোন পণ্যের চাহিদা বাজারে বেশি, ক্রেতাকে আকৃষ্ট করতে বা নির্ভরযোগ্যতা অর্জনে কি কি পদক্ষেপ নেওয়া প্রয়োজন ইত্যাদি বিষয়গুলো লক্ষ্য করতে হবে।তারপর নির্ধারণ করতে হবে ঠিক কোন পণ্যের ব্যাবসা করতে চাইছেন। ব্যবসায় সফলতা পেতে তাড়াহুড়া পরিহার করে সময় নিয়ে সরাসরি অন্যরা কিভাবে ব্যবসা করছেন তা দেখে শিখতে হবে তাহলে ঝুঁকির পরিমান কম থাকে। ই-কমার্স ব্যবসাটি যেহেতু ওয়েবসাইট নির্ভর সেহেতু ওয়েবসাইট তৈরির ব্যাপারে ব্যবসা উপযোগী ফিচার তৈরি, ওয়েবসাইটটি নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণ, ওয়েবসাইটে বিদ্যমান কাংখিত সুযোগ-সুবিধা ইত্যাদি বিষয় মাথায় রেখে সময় নিয়ে পরিকল্পনা করে ওয়েবসাইট তৈরি করতে হবে। এছাড়া ই-কমার্স ব্যবসায়ের ক্ষেত্রে ডিজিটাল মার্কেটিং, সার্চ ইঞ্জিন অপ্টিমাইজেশন সম্পর্কে পারদর্শিতা আপনাকে কয়েক ধাপ এগিয়ে রাখবে।
বর্তমানে বাংলাদেশে ই-কমার্স খাতে কর্মরত প্রায় ১ লাখ ২৫ হাজার কর্মীর ২৬ শতাংশ নারী। দেশের বিপণনে ব্যবহৃত প্রায় ২০ হাজার ফেসবুক পেজের মধ্যে ১২ হাজার পেজ চালাচ্ছেন নারীরা। বাড়ির কাজের পাশাপাশি বাড়তি সময় ও নিজের প্রতিভাকে কাজে লাগিয়ে দেশীয় পণ্য উৎপাদনের মাধ্যমে ক্রেতার কাছে উপস্থাপন ও বিক্রয়ের জন্য অনলাইন কে কাজে লাগাচ্ছেন তারা। এভাবে দেশে ও বিদেশে নিজেদেরকে নারী উদ্যোক্তা হিসেবে গড়ে তোলার চেষ্টা করছেন এবং সফলতার দেখাও পাচ্ছেন অনেকেই।