বাংলাদেশের মোট জনসংখ্যার প্রায় ৪৯.৪% নারী হলেও আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে পুরুষের তুলনায় নারীর অংশগ্রহণ বরাবরই কম। সামাজিক নানা প্রতিকূলতার কারণে মেধা ও ইচ্ছাশক্তি থাকার সত্বেও নারীরা ইচ্ছানুযায়ী সব ধরণের কর্মক্ষেত্রে অংশগ্রহণের সুযোগ পান না।তবে অতীতের তুলনায় বর্তমানে শুধু চাকরিই নয় স্বাধীন ব্যবসায়ও পুরুষের পাশাপাশি নারীর অংশগ্রহণ লক্ষণীয়। বর্তমান সময়ে বিভিন্ন প্রাতিষ্ঠানিক এবং ব্যক্তিগত অনুষ্ঠানগুলো রুচিশীল ও দৃষ্টি নান্দনিক ভাবে পরিচালনার জন্য আমাদের দেশে ইভেন্ট ম্যানেজমেন্টর চাহিদা বেড়েই চলেছে। ইভেন্ট ম্যানেজমেন্ট পরিচালনা করা একটি চ্যালেঞ্জিং পেশা হলেও পুরুষ অথবা নারী যে কোন সৃষ্টিশীল মানুষ এ সেক্টরে সফল ভাবে নিজের ক্যারিয়ার গড়ে তুলতে পারেন।
উদ্যোক্তা হয়ে উঠতে ব্যবসা পরিচালনার জন্য নিজের দক্ষতা ও পারদর্শিতার পাশাপাশি মূলধনও জরুরী।
সেক্ষেত্রে অল্প পুঁজিতে শুরু করা যায় কিন্তু কাজের ক্ষেত্র ক্রমবর্ধমান এমন ব্যবসা নির্বাচন করা শ্রেয়। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ইভেন্ট ম্যানেজমেন্ট ব্যবসা পুরাতন হলেও বাংলাদেশে নতুনই বলা চলে। যেকোনো অনুষ্ঠান আয়োজনে বিশেষ করে কর্পোরেট প্রতিষ্ঠানগুলোতে এর ব্যাপক চাহিদা রয়েছে। এখনকার সময়ে গায়ে হলুদ, বৌভাত, বিবাহ বার্ষিকী, জন্মদিন, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, মেলা, প্রদর্শনী, ফ্যাশন শো, সমাবর্তন, পিকনিক, অফিসিয়াল মিটিং, সেমিনার, কর্পোরেট অনুষ্ঠানসহ ছোট-বড় সব ধরনের অনুষ্ঠান আয়োজনের ক্ষেত্রে ইভেন্ট ম্যানেজমেন্ট ফার্ম গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকে। ভেন্যু নির্বাচন, বিজ্ঞাপন, সাউন্ড সিস্টেম, লাইটিং সহ সকল ডেকোরেশন, ক্যাটারিং সার্ভিস, মিডিয়া কভারেজ, আমন্ত্রণপত্র বিতরণ, অনুষ্ঠান উপস্থাপনাসহ সকল বিষয় সঠিকভাবে পরিচালনায় ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান গুলো এখন ইভেন্ট ম্যানেজমেন্ট ফার্ম গুলোর ওপর নির্ভরশীল। পেশা হিসেবে ইভেন্ট ম্যানেজমেন্ট তাই আকর্ষণীয় ও লাভজনক ব্যবসা।
বর্তমানে বাংলাদেশে কর্পোরেট ইভেন্ট ও ওয়েডিং ইভেন্ট এ দুই ধরনের ইভেন্ট ম্যানেজমেন্ট প্রতিষ্ঠান কাজ করে থাকে। এ ব্যবসায় প্রাথমিক পর্যায়ে অফিস না নিয়ে দুই থেকে তিন লাখ টাকা বিনিয়োগের মাধ্যমে কাজ শুরু করা যেতে পারে। অল্প পুঁজির ক্ষেত্রে শুরুতে বড় কাজ এর দায়িত্ব না নিয়ে ছোট কাজ পরিচালনা করতে হবে। তবে ইভেন্ট ম্যানেজমেন্ট পরিচালনায় কাজের সুযোগ এবং আয় নির্ভর করে কোন একটি ইভেন্ট নির্ধারিত বাজেটের মধ্যে কতোটা আকর্ষণীয় ভাবে পরিচালনার দক্ষতা আপনার আছে এটার ওপর। কাজের মান ঠিক রেখে গ্রাহককে সন্তুষ্ট রাখার ওপরই নির্ভর করে পরবর্তীতে ঐ প্রতিষ্ঠান থেকে পুনরায় কাজের সুযোগ পাওয়া বা না পাওয়া। ছোট বা বড় সকল ব্যবসার ক্ষেত্রেই প্রচার খুবই গুরুত্বপূর্ণ। একারণে ইভেন্ট ম্যানেজমেন্ট পরিচালনায় নেটওয়ার্কিংয়ে বিশেষ গুরুত্ব দিতে হবে। গ্রাহকদের সাথে নিয়মিত যোগাযোগ, বিভিন্ন ধরনের পেশাগত ইভেন্টগুলোয় অংশগ্রহণ, সুবিধা অনুযায়ী বিভিন্ন মাধ্যমে বিজ্ঞাপন প্রদান ইত্যাদি ব্যবসার প্রচার ও প্রসারে সহায়ক ভূমিকা রাখে।
‘ইশরাত আমিন ফটোগ্রাফি’ এর প্রতিষ্ঠাতা এবং ড্রিম মার্চেন্ট ইভেন্ট সলিউশনের সহ-প্রতিষ্ঠাতা ইশরাত আমিন একজন পেশাদার ওয়েডিং ফটোগ্রাফার। ওয়েডিং ফটোগ্রাফি পেশায় তিনিই প্রথম নারী যিনি পুরুষদের পাশাপাশি এই শিল্পে সফল ভাবে আধিপত্য বিস্তার করছেন। আমাদের দেশের অনেক তরুণীর এই পেশায় যোগদানের ক্ষেত্রে অনুপ্রেরণার উৎস তিনি। ইশরাত আমিন সম্প্রতি ‘সেরা বিবাহের ফটোগ্রাফার’ এর জন্য মিলেনিয়াম ব্রিলিয়েন্স অ্যাওয়ার্ড পেয়েছেন। বিবাহের ইভেন্ট পরিকল্পনা ও পরিচালনা প্রতিষ্ঠান ‘ফেইরি লাইট ‘ এর প্রতিষ্ঠাতা সায়মা নাজনিন প্রভা, শাগুফতা রহমান এবং আরোশি বিনতে আমির। তাদের এই প্রতিষ্ঠান বিবাহের ইভেন্টের পরিকল্পনা, আলোকসজ্জা, বিবাহের ফটোগ্রাফি ,বিবাহের ভিডিওগ্রাফি, প্রি-ওয়েডিং ফটোগ্রাফি ইত্যাদি পরিসেবাসমূহ প্রদান করে থাকেন। শুরুটা অনলাইন ভিত্তিক হলেও বর্তমানে তারা অফিসিয়াল ভাবে সফলতার সাথে তাদের প্রতিষ্ঠান পরিচালনা করছেন। সফল এসকল নারী উদ্যোক্তাদের মতো যে সকল নারীরা ভবিষ্যতে ইভেন্ট ম্যানেজমেন্ট সেক্টরে কাজের কথা ভাবছেন, তারা অধ্যয়নরত অবস্থায় বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে খন্ডকালীন চাকরির মাধ্যমে অভিজ্ঞতা বাড়াতে পারেন।
লিডারশিপ এবং ব্যবসা উন্নয়নবিষয়ক প্রশিক্ষণগুলোও এসকল ব্যবসা পরিচালনায় দক্ষ হয়ে উঠতে সহায়ক ভূমিকা রাখে। বর্তমানে বাংলাদেশে ছোট বড় অনেক প্রতিষ্ঠান ইভেন্ট ম্যানেজমেন্টের উপর কোর্স করিয়ে থাকেন যেমন আইডল ফোকাস নামক একটি প্রফেশনাল ট্রেনিং প্রতিষ্ঠান ‘সার্টিফিকেট কোর্স অন ইভেন্ট ম্যানেজমেন্ট’ নামক একটি শর্ট কোর্স পরিচালনা করে থাকেন। এছাড়া অনলাইনেও ইভেন্ট ম্যানেজমেন্টের উপর বিভিন্ন ধরনের কোর্স রয়েছে। এসকল কোর্স গুলো কর্মজীবনে কাজের ক্ষেত্রে ইতিবাচক ভূমিকা রাখবে। সুযোগ থাকলে ব্যবসা শুরুর পূর্বে ইভেন্ট ম্যানেজমেন্ট সেক্টরে অভিজ্ঞ ব্যক্তিদের কাছ থেকে পরামর্শ নিতে পারেন।
যেহেতু পেশাটি অভিজ্ঞতা ও সৃজনশীল দক্ষতার ওপর অনেকাংশে নির্ভরশীল সেহেতু এই সেক্টরে সফল হতে চাইলে শুরুতে কোন ইভেন্ট ম্যানেজমেন্ট ফার্মে কাজ করে নিজেকে যাচাই করে নেওয়াই উত্তম। কর্মক্ষেত্রে অভিজ্ঞতা বৃদ্ধি পেলে নিজেই গড়ে তুলতে পারেন একটি ইভেন্ট ম্যানেজমেন্ট ফার্ম তবে অভিজ্ঞতার ঘাটতি থাকলে অর্থ বিনিয়োগ করলেও এ পেশায় লাভবান হতে পারবেন না।
কয়েক মাস ধরে করোনা মহামারীতে গণজমায়েতসহ সব ধরনের সামাজিক অনুষ্ঠান নিষিদ্ধ হবার কারণে ইভেন্ট ম্যানেজমেন্ট প্রতিষ্ঠান গুলো অস্তিত্ব সংকটে ভুগছে। পরিস্থিতি দীর্ঘ হলে এ খাতের প্রায় সকল প্রতিষ্ঠানই সংকটে পড়বে বলে ধারণা করা হচ্ছে। কিন্তু কোন মহামারীই চিরস্থায়ী নয়।
সম্প্রতি সীমিত পরিসরে সবকিছু খুলে দেওয়ায় ওয়েডিং ইভেন্ট ম্যানেজমেন্ট প্রতিষ্ঠানগুলো ধীরে ধীরে কাজ শুরু করছে। লক্ষ্য ইভেন্ট ম্যানেজমেন্ট ব্যবসা হলে, আশাহত না হয়ে ধীরে ধীরে প্রস্তুত হতে থাকুন, এবং সঠিক সময় পূর্ণ পরিকল্পনাসহ কাজে নেমে পড়ুন। প্রশিক্ষণ এবং অনুশীলনের পাশাপাশি প্রবল ইচ্ছাশক্তি থাকলে এ পেশায় নিজেকে গড়ে তুলতে পারেন নারী-পুরুষ উভয়ই।